Sunday, April 10, 2016

বই প্রকাশের আদ্যোপান্ত (বই প্রকাশ-এর পরিবর্তিত ও বর্ধিত সংস্করণ)

সুপরিচিত মাধ্যমে নিজের লেখাটি দেখতে সাধারণত সকল লেখকেরই কাম্য হতে পারে । আর সেই লেখাগুলি বই আকারে প্রকাশিত হলে তা লেখকের লেখার উৎসাহ বাড়িয়ে দেয় অনেকগুণ।
অনলাইনে লেখেন এমন অনেকেরই প্রকাশিত এক বা একাধিক বই রয়েছে। অনেকেই লিখেছেন অনেক কিন্তু বই আকারে প্রকাশের ভাবনা আসেনি বা কীভাবে বই প্রকাশ করবেন তা নিয়ে সঠিক কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন নি।
যারা লিখছেন কিন্তু এখনও বই আকারে নিজের লেখা প্রকাশিত হয়নি তাদের জন্যে মূলত এই লেখা।

বই প্রকাশ কয়েকভাবে করা যেতে পারে
কোন প্রকাশক যদি লেখকের লেখা প্রকাশের জন্যে নির্বাচন করে নিজের খরচে প্রকাশ করেন।

এছাড়া কোন প্রকাশক নির্দিষ্ট সংখ্যক বই প্রকাশ করে দিবেন তাকে খরচের টাকাটা দিয়ে দিতে হবে।

অথবা স্বীকৃত আরেকটি মাধ্যম আছে প্রকাশক নির্দিষ্ট সংখ্যক বই প্রকাশ করে দিবেন তাকে ৪০% কমিশনে বইগুলো কিনে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কিনে নিলেও প্রকাশক নিজ দায়িত্বেই বিক্রীর
ব্যবস্থা করে থাকেন।

লক্ষ্য:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনার প্রাক্তন পরিচালক বিমল গুহ এর মতে, লেখক এবং প্রকাশককে নিম্নোক্ত তিনটি বিষয় মাথায় রেখে বই প্রকাশের কাজ করা উচিত। উল্লেখ্য যে, এদের মতে, যে কোন দু'টিকে বই প্রকাশে বেছে নিতে হয়।
1) Costing
2) Schedule
3)Quality
এবং বই প্রকাশে যে ব্যাপারকে প্রাধান্য দেয়া উচিত তা সংক্ষেপে KISMII বা
Keep it simple and make it interesting .

লেখা সংগ্রহ বা একত্রিত করণ: লেখক তার টার্গেট লেখাগুলিকে একত্রিত করে কম্পোজ এর কাজ করে নিতে পারেন। বর্তমানে বেশিরভাগ লেখকই কাগজের চেয়ে ডিজিটাল ডিভাইসে নিজের লেখা সংরক্ষণ করে থাকেন। সেক্ষেত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলোকে একত্রিত করে বইয়ের কী নাম হবে, কবিতা হলে প্রতিটা কবিতার নাম, গল্প, প্রবন্ধ বা যাই হোক নামের ব্যাপারে আরেকবার ভেবে চূড়ান্ত করে নিতে পারেন। এতে লেখায় যত্নের ছাপ পাওয়া যায়।
 
সম্পাদনা: প্রাথমিক সম্পাদনা লেখক নিজেই করতে পারেন। বানানের ব্যাপারে লেখককে কোনরকমের ছাড় দেয়া চলবে না । একটি বইয়ের মান নির্ভর করে বানানের উপরও বটে। কেননা পাঠক যখন বই হাতে নিবেন তখন ভুল বানানে প্রকাশিত বইটি পাঠকের পড়ার আগ্রহকে কমিয়ে দিবে। তাই বাংলা একাডেমির প্রমিত বানান সম্পর্কে লেখকের স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে । হাতের কাছে বাংলা থেকে বাংলা অভিধান থাকা জরুরী । এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অন্তর্জালে বেশি সময় কাটাতে অভ্যস্থ অনেকেই অভিধান না দেখে নেটে সার্চ দিয়ে বানান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চান যা নিজের লাভের চেয়ে ক্ষতিই হবে বেশি ।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রকাশকেরই বেতনভোগী সম্পাদক রাখা সম্ভব নয়। এখানে প্রকাশক নিজেই প্রকারান্তরে সম্পাদকের কাজটি করে থাকেন ।
তাই লেখক নিজে এবং পেজ মেকাপ যাকে দিয়ে করানো হবে তার দক্ষতা বইয়ের গুণগত মানের ক্ষেত্রে কমবেশি হয়ে থাকে ।

ডিজাইন: একটি বইয়ের ডিজাইন বা নকশা কেমন হবে সে বিষয়ে যত্ন এবং অভিজ্ঞতাই নির্ভর করে বইটির উপস্থাপন কতোটা দৃষ্টিনন্দন হবে। ইচ্ছেমতো ছবি জুড়ে দিলেই যে দৃষ্টি নন্দন হবে তেমন কিন্তু নয় ।

ISBN (International Standard Book Number):
বর্হিবিশ্বে আপনার বইটির খোঁজ মূলত এই আইএসবিএন থেকেই পাঠক খুঁজে পেতে পারেন । বই প্রকাশের সাথে লেখকের বইটির একটি আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড বই নম্বর দেবার কাজটি লেখক নিজে দায়িত্ব নিয়ে করাতে পারেন বা প্রকাশকও করিয়ে নিতে পারেন ।

ISBN এর জন্যে বর্তমানে পান্ডুলিপির এক কপি সহ আবেদন পত্র জমা দিতে হবে আগারগাঁও এ অবস্থিত জাতীয় গ্রন্থাগার ভবনের নিচতলার অফিসে অফিসচলাকালীন সময়ে ।
ISBNএর নিজস্ব ওয়েবসাইট
http://www.isbn.org/

উইকিপিডিয়ায় ISBN


কপি রাইট:
© কপি রাইট

একটি বই প্রকাশ করলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না । বইটির লেখার স্বত্ত্ব যেন লেখক বা লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশকের থাকে সেজন্যে কপিরাইট আইনের আওতায় রেজিস্ট্রেশন করা উচিত যেন কেউ লেখা চুরি করে পার পেয়ে যেতে না পারে ।

নির্ধারিত সময়ে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের জন্যে :
●আবেদন পত্র – ৩কপি (নির্ধারিত)- অনলাইন অথবা অফিসে জমা দিতে হবে ।
●ট্রেজারি চালান (টাকা জমা)ফি – ১০০০/= প্রতিটি আবেদনের বিপরীতে
●অঙ্গীকারনামা-৩০০ টাকা নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প (মৌলিক কর্মের ঘোষণাপত্র)
●পান্ডুলিপি, সাহিত্যকর্ম, সিডি, ক্যাসেট ইত্যাদি…কর্মের ২ কপি করে জমা দিতে হবে
●ট্রেজারি চালান কোড নং ১-৩৪৩৭-০০০০-১৮৪১
●চারুকর্মের ক্ষেত্রে কর্মের ৩ কপি জমা
●কর্ম হস্তান্তর হলে হস্তান্তরের দলিল ৩০০/= ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্প
●শিল্পকর্ম জমা দিতে হবে –দেলোয়ার জামিল
●সাহিত্য, সফটওয়্যার, নাটক, সিনেমা, পান্ডুলিপি জমা দিতে হবে –খালেদ হোসেন চৌধুরী
কপিরাইট আইন

এছাড়া সহজ একটি উপায় আছে তা হলো বইয়ের পাণ্ডলিপি একটি প্যাকেটে সিলগালা করে লেখক প্রাপক এবং প্রেরক উভয়ের ঠিকানাতেই নিজের নাম দিয়ে রেজিস্ট্রি করে ডাকঘর থেকে পোস্ট করে তা নিজের সংরক্ষণে রেখে দিতে পারেন পরবর্তীতে লেখকের লেখা কেউ চুরি করলে যেন লেখক উপযুক্ত প্রমাণ প্রদর্শন করতে পারেন ।

বিজ্ঞজনের বক্তব্য সংযোজন: একটি বইয়ের গুরুত্ব বেড়ে যায় যদি বইয়ে শুরুতে বইটি এবং লেখক সম্পর্কে কোন বিজ্ঞজন বা প্রথিতযশা সাহিত্যিকের বক্তব্য সংযোজন করা সম্ভব হয়।

প্রেস: যিনি লেখক তার কাজ হবে প্রকাশকের সাথে প্রেসের বিষয়গুলি নিয়ে খোলামেলা আলাপ করে নেয়া । কেননা প্রেসের কাজের সামান্য অযত্নের কারণে লেখকের অনেক সাধের একটি বইয়ের চূড়ান্ত ক্ষতি হতে পারে ।
বই চূড়ান্ত ভাবে পাওয়ার আগে স্যাম্পল কপি দেখে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে নেয়া উচিত বইটি দেখতে কেমন হবে। প্রেসের কোন কাজে অসংগতি থাকলে তা শুধরে বই বের করা উচিত ।

বাঁধাই: বই বাঁধাই বই প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ ।
বাধাইকরার পর বই ছেঁটে ফেলতে হয় আর ছেটে ফেলার সময় যেন এমন ভাবে ছাটা না হয় যাতে বইয়ের সৌন্দর্য নষ্ট হয় । এব্যাপারে লেখক যদি সচেতন থাকেন তবে প্রকাশকের সাথে এবিষয়ে আলাপ করে নিতে পারেন ।

বইমেলা:
ফেব্রুয়ারি ভিত্তিক জাতীয় গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে অনেকেই বই প্রকাশে আগ্রহী হয়ে থাকেন । এই পরিকল্পনা যাদের মাথায় আছে তারা একটু বেশি সময় হাতে রেখে কাজ শুরু করতে পারেন । তাতে অনেকভুলভ্রান্তি শোধরানোর সুযোগ থাকে।

মোড়ক উন্মোচন: বই প্রকাশিত হলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না। আরো কিছু কাজ থাকে যা লেখকের বই প্রকাশকে পূর্ণতা দান করে। তার একটি হলো মোড়ক উন্মোচন। বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে এই কাজটি বইমেলার সময় অনায়াসেই করে নেয়া যায়। আর মোড়ক উন্মোচনের আগে বাংলা একাডেমি থেকে যে ঘোষণার ব্যবস্থা করা হয় সেখানে লেখক আর বইয়ের নাম এন্ট্রি করে সময় জানিয়ে দিতে হয়। 
মোড়ক উন্মোচনেও লেখক/প্রকাশকের উচিত কোন সুপরিচিত ব্যক্তির দ্বারা উন্মোচনের কাজটি করিযে নেয়া ।
[মোড়ক উন্মোচনের সময় লেখক মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা করলে মন্দ হয় না ।]

প্রচারেই প্রসার: বইতো প্রকাশ হলো । মোড়ক উন্মোচনও হলো কিন্তু এর যথার্থ প্রচার না হলে কিন্তু অনেকেই জানবে না বইটি সম্পর্কে।
দেশের নামী দামী অন্য প্রকাশকের বইয়ের চেয়ে প্রথমার বইয়ের খবর মানুষ বেশি জানে প্রচারের কারণে। তাই নতুন প্রকাশিত বইয়ের লেখকরা অনলাইনে তাদের প্রচারণার কাজটি চালাতে পারেন। এক্ষেত্রে সামহোয়্যারইন ব্লগে অনেকেই তাদের প্রকাশিত বইয়ের পরিচিত দিয়ে পোস্ট করে থাকেন। এছাড়া ফেসবুকে বইটির কভারফটো দিয়ে এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিয়ে একটি পেজ খোলা যেতে পারে। যাতে বইয়ের বিভিন্ন সময়ের খবর সেই পেজ-এ শেয়ার করা যেতে পারে।

সব শেষে একটি অনুরোধ বা পরামর্শ যাই বলুন না কেন, টাকা আর লেখা থাকলেই বই প্রকাশ করা উচিত নয়। লেখাটি বই হিসেবে প্রকাশের যোগ্য কি না তা ভালো ভাবে ভেবে দেখুন। মনে রাখবেন আপনার বইটি ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছে তার গুণগতমান নিশ্চিত করুন ।

-------------------------------------------




বইয়ের খরচাপাতি
 বাই বুক
রাচী গ্রন্থ নিকেতন 

জাতীয় সাহিত্য প্রকাশন-এর পুরোধা জনাব মোরশেদ আলম-এর মতে-
১০ ফর্মার একটি বই প্রকাশের আনুমানিক খরচ :
●কভার পেপার (দুই রকম আর্টপেপার
অফসেট-১২০ গ্রাম বা ১০০গ্রাম হতে পারে)- ২৫০০/=
●কভার ডিজাইন পজেটিভ সহ চার কালার -৩০০০/=
●কভার প্লেট ৪টি – ৮০০/=
●কভার ছাপা - ২০০০/=
●কভার লেমিনেশন – ৭৫০০/=
●বইয়ের কাগজ – ১১০০০/=
●বইয়ের ছাপা – ১০*৪০০=৪০০০/=
●মূল বইয়ের প্লেট একপোজ সহ ১০টা
(একপোজ= ট্রেসিং প্লেট) -৪৪০০/=
● বই বাঁধাই – ১০,০০০/=
● বই কম্পোজ ১০ ফর্মা
(ট্রেসিং সহ) – ১০*৬০০=৬০০০/=
●প্রুফ রিডিং – ৩০০০/=
১০ ফর্মায় প্রতিবারে প্রুফ রিডিং ১০০০/= করে তিনবারে ৩০০০/=টাকা




♥সবাইকে অনেক ধন্যবাদ যারা কষ্ট করে এই কাঠখোট্টা পোস্টটি পড়লেন ।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা:
বাংলা একাডেমির পরিচালক অপরেশ ব্যানাজী

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত পোস্ট

'অবদমিত অভিমান'- ২০১৭ এর বইমেলায় প্রকাশিতব্য সময় প্রকাশন এর গল্প সংকলনের বই

প্রথম গল্প লিখেছিলাম আজ থেকে ২০ বছরেরও বেশি সময় আগে।