Thursday, May 1, 2014

নারীর অধিকার বাস্তবায়ন :গবেষণা অভিজ্ঞতা


নারী জাগরণ ও নারী মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃত্ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বিশ্বাস করতেন, 'সমাজের অর্ধ অঙ্গ বিকল করিয়া রাখিয়া উন্নতি লাভ করা অসম্ভব'। নারী মুক্তির কথা, নারী অধিকারের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির কথা। 

কিছুদিন আগে সাভারে নারীর অধিকার, বৈষম্য, বৈষম্য দূরীকরণের উপায় নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল গৃহিণীসহ সমাজের বিভিন্ন পেশার নারীদের সাথে। যাদের মধ্যে বিশেষ করে মাশরুম চাষি, পোশাক শ্রমিক, ব্যক্তিগতভাবে দর্জির কাজে নিয়োজিত প্রায় ২৫ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে। 

'অধিকার' শব্দটি যখন সমাজ, রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হয়ে থাকে তখন তাকে অধিকার বলা যেতে পারে। কিন্তু যাদের জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই নাভিশ্বাস উঠে যায় এই নারীদের কাছে 'অধিকার' শব্দটি খুব গভীরভাবে তেমন কোন অর্থ বহন করে না। তাদের কাছে 'অধিকার' হলো 'ভালো'ভাবে থাকা, 'ভালো' খাওয়া, 'ভালো' পরতে পারা । 

"নারী অধিকার" পরিভাষাটি বলতে বোঝায় এক ধরনের স্বাধীনতা, যা কন্যাশিশু থেকে শুরু করে সকল বয়সের নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এই অধিকার হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক, আইনানুগ, আঞ্চলিক সংস্কৃতি দ্বারা সিদ্ধ বা কোনো সমাজের আচরণের বহিঃপ্রকাশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই অধিকারকে অস্বীকার করতেও দেখা যায়। সীমান্ত পেরিয়ে বিভিন্ন দেশে এই অধিকারের বিভিন্ন রকম সংজ্ঞা ও পার্থক্য দেখা যায়, কারণ এটি পুরুষের অধিকার থেকে ভিন্ন এবং এই অধিকারের সপক্ষে আন্দোলনকারীদের দাবি যে, নারীর অধিকার প্রচলনের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দুর্বলতা রয়েছে। 

যেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে নারী অধিকার প্রযোজ্য হয়, তা সুনির্দিষ্ট না হলেও এগুলো মূলত সমতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা কেন্দ্রিক। যেমন ভোটদানের অধিকার, অফিস-আদালতে একসাথে কাজকর্ম করার অধিকার, কাজের বিনিময়ে ন্যায্য ও সমান প্রতিদান (বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি) পাবার অধিকার, সম্পত্তি লাভের অধিকার, শিক্ষার্জনের অধিকার, সামরিক বাহিনীতে কাজ করার অধিকার, আইনগত চুক্তিতে অংশগ্রহণের অধিকার এবং বিবাহ, অভিভাবক, ও ধর্মীগত অধিকার। নারী ও তাদের সহযোগীরা কিছু স্থানে পুরুষের সমান অধিকার আদায়ের সপক্ষে আন্দোলন, বিভিন্ন প্রকার ক্যাম্পেইন ও কর্মশালা চালিয়ে যাচ্ছে। 

কথা বলেছিলাম শুকরানী (৩০)র সঙ্গে। রানা প্লাজা ধসের ঘটনার শিকার ৪ দিন ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা এই গার্মেন্টস কর্মী হারিয়েছেন তার এক কন্যাকে। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে গেছেন। বর্তমানে কোন কাজ না পেয়ে মৌলিক চাহিদা পূরণের তাগিদে উদভ্রান্ত অবস্থায় দিন কাটছে এই নারীর। 

নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহিত সনদ Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women (CEDAW) জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বের প্রথম যে কয়টি দেশ অনুমোদন করে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ এই দলিল অনুমোদন করে স্বাক্ষর করেছে ১৯৮৪ সালের ৬ই নভেম্বর। 

সিডও সনদে বর্ণিত নীতিমালার বাস্তবায়ন এবং সেই লক্ষ্যে, সকল আকারে এ ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য হলেও ধারা ১ [সংবিধানের ধারা ২৮ (১), ২৮ (২), ২৮ (৩), ১০ নারী পুরুষ নির্বিশেষে রাষ্ট্র ও গণজীবনে সমান অধিকার]-এর কথা বলা হলেও এই নারীদের মধ্যে কাউকেই সেই সমান অধিকার প্রাপ্তির কথা শোনা যায়নি। 

কেস স্টাডি-১: নিজের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে পরিবার-পরিজনদের ত্যাগ করে সনাতন ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে ৩৮ বছরের রিনা (ছদ্মনাম) খুব বেশিদিন স্বামীর সংসার করতে পারেননি। তার আগেই বৈধব্যের নিঃসঙ্গতায় জড়িয়ে পড়েছেন। মাশরুম চাষি এই নারী প্রথমত হিন্দু হওয়ার কারণে বঞ্চিত হয়েছেন তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে এবং একটি মাত্র কন্যা শিশু থাকায় স্বামীর সম্পত্তিও বেহাত হয়ে গেছে। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র পারেনি এই নারী এবং তার একমাত্র মাদ্রাসা পড়ুয়া কন্যার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে। একা থাকার কারণেই বিয়ের প্রস্তাব প্রায়ই আসে; যা তার মানসিক শান্তির অন্তরায়। 

অথচ সিডও ধারা ১৬ [সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৯ (১), ৪২ আইনের দৃষ্টিতে সমতা, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার, দেশের যে কোন স্থানে বসতি স্থাপন, চিত্ত বিনোদনের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার] অনুযায়ী, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এই নারী। 

কেসস্টাডি-২: সুলতানা আক্তার (৪২), ঘরের বাইরে কাজ করতে যাওয়ার অনুমতি না পাওয়া এই গৃহিণী নিজের ভিটায় হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল পালন করতে পারেন না পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের বাধার কারণে। উত্তরাধিকার সম্পত্তি যতটুকু পাওয়ার কথা ছিল মায়ের হস্তক্ষেপের কারণে তা থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। তাদের সবার সাথে কথা বলার পর প্রাপ্ত তথ্য থেকে যা বোঝা গেল তা হচ্ছে- 

মাশরুম চাষিদের মধ্যে ঘরে কাজ করার সুবিধা থাকলেও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য রাষ্ট্রীয় সহযোগিতাও প্রয়োজন; যা তারা রাষ্ট্র থেকে পাচ্ছেন না। -রানা প্লাজা ধসের মতো এতো বড় একটা মর্মান্তিক ঘটনার শিকার সেখানকার গার্মেন্টস কর্মীরা কোন রকম সরকারি সাহায্য পাননি। এমনকি তাদের প্রাপ্য বোনাসও সবটুকু পাননি। 

অন্তঃসত্ত্বা নারীদের নতুন কোন গার্মেন্টসে চাকরিতে নিয়োগ দান করা হচ্ছে না মাতৃকালীন বিভিন্ন সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে। 

অথচ, সিডও ধারা ৭ [সংবিধানের ধারা ৯, ১০, ১৯ (১), ২৮ (১), ২৮ (২), ২৯ (২), ৪০, ৬৬ অংশগ্রহণ ও অনুমোদনের সমতা, কর্মের সমতা, পেশার স্বাধীনতা, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সমতা]তে নারীর কর্মের সমতা, পেশার স্বাধীনতার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত রয়েছে। 

-অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নারী তাদের সন্তানকে বিদ্যালয়ে পড়াতে পারছে না, বিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য আনুষঙ্গিক খরচ বহন করতে না পারার জন্য। 

সিডও ধারা ১০ [সংবিধানে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে] মৌলিক প্রয়োজনে শিক্ষার অধিকার, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুযোগের কথা থাকলেও বাস্তবে তা মোটেও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। -উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নারীরা প্রতিনিয়তই বা হলেও এর যথাযথ বাস্তব প্রয়োগ নেই। এ সকল বৈষম্য দূরীকরণে এসব অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া নারীদের সাথে কথা বললে তারা সরকারের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এর সমাধান প্রত্যাশা করে থাকে। 

বাংলাদেশের সরকার যদি সিডও সনদ ও সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা সঠিকভাবে গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তাহলে আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতেই নারীরা তাদের যথাযথ অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হবেন । 


দৈনিক ইত্তেফাকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রকাশিত

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত পোস্ট

'অবদমিত অভিমান'- ২০১৭ এর বইমেলায় প্রকাশিতব্য সময় প্রকাশন এর গল্প সংকলনের বই

প্রথম গল্প লিখেছিলাম আজ থেকে ২০ বছরেরও বেশি সময় আগে।